বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ
বাজেটের সাহায্যে একটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকার কার্য সম্পাদন ও নিয়ন্ত্রণ করাকে বাজেটারী নিয়ন্ত্রণ বা বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ বলে। অর্থাৎ অর্জিত ফলাফলকে বাজেটের সাথে তুলনা করে যে নিয়ন্ত্রণ মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেটিই বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ।
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণের দুটো উপযোগী সংজ্ঞা নিম্নরূপ-
১. G. R. Terry বলেন, “কার্যফল পরীক্ষা, বাজেটের সাথে কার্যফলের তুলনামূলক বিচার, সম্পাদিত কাজের অনুমোদন এবং কোনরূপ বিচ্যুতি ঘটলে তা সংশোধন করে বাজেটের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করাকে বাজেটারী নিয়ন্ত্রণ বলে।”
২. E. F. L. Brech বলেন, “প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন লক্ষের সাথে অর্জিত ফলাফল পরিমাপ ও তদানুযায়ী নির্দেশিত ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক পদ্ধতিকে বাজেটারী নিয়ন্ত্রণ বলে।”
উল্লেখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত ফলাফলকে প্রস্তুতকৃত বাজেটের সাথে তুলনা করে বিচ্যুতি নির্ণয় করা হয় এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাকে বাজেটারী নিয়ন্ত্রণ বলে।
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণের সুবিধা
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ বর্তমান যুগের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনীয় নিয়ন্ত্রণের একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল। এটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা গেলে নিয়ন্ত্রণ কার্য সহজে সফল হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং নানাবিধ সুবিধাও অর্জন করা সম্ভব। নিচে এর কিছু সবিধাদি বর্ণনা করা হলো-
১. পরিকল্পনার উন্নতি বিধান
বাজেটে প্রমাণের সময় প্রণয়নকারীকে তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রচুর চিন্তাভাবনা করতে হয়। তার এ মনোযোগসমৃদ্ধ চিন্তা ভাবনার ফলে বাজেট একটি উৎকৃষ্ট পরিকল্পনায় পরিণত হয় যা পরিকল্পনার কার্যকারিতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে।
২. সমন্বয়ে সহায়তা
বাজেটের মাধ্যমে বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। বিভাগসমূহ তাদের বাজেট প্রণয়নের সময় অন্যান্য বিভাগ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। তথ্য আদান-প্রদানের ফলে বিভিন্ন কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধন সহজ হয়।
৩. নিয়ন্ত্রণের সুবিধা
বাজেট বিদ্যমান থাকলে কর্মীরা বাজেটে উল্লেখিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য তৎপর হয়। কারণ তারা জানে যে, বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা তাদের দায়িত্ব। এতে কর্মীদের কার্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
৪. লক্ষ্য অর্জন
বাজেটারী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনকে সহজতর করে তোলে। বাজেট যে লক্ষ্য স্থির করে তাকে আদর্শমান হিসেবে ধরে নেয়া হয় এবং তা দ্বারা কার্য সম্পাদনের ফল পরিমাপ করা হয়। এ ফলকে বাজেটে উল্লেখিত লক্ষ্যের সাথে তুলনা করা হয়। তুলনাকালে যদি কোন দোষত্রুটি ধরা পড়ে তবে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিয়ন্ত্রণকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রণের কৌশল সমূহ আলোচনা কর।
৫. অপচয় হ্রাস
এরূপ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বিদ্যমান থাকলে প্রতিষ্ঠানের কোন খাতে কত খরচ হবে তা পূর্ব হতেই জানা যায়। ফলে বিভিন্ন বিভাগের কর্মীগণ বাজেট সীমার মধে থেকে ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা করে। এতে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের অপচয় হ্রাস পায়।
৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণ
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক বা নির্বাহীগণ কর্তৃক বিভিন্ন প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব তথ্যের প্রয়োজন হয় বাজেটে সেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত থাকে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর হয়।
৭. যথাযথভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় নির্বাহীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কি হবে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ফলে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীগণ অত্যন্ত সচেতনতার সাথে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারেন।
৮. উৎপাদনের স্থায়িত্ব বিধান
নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ দ্রব্য উৎপাদনের জন্য উৎপাদন বাজেট তৈরি করা হয় যা উৎপাদনের স্থায়িত্ব বিধানে সহায়তা করে।
৯. উত্তম শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক
বাজেটারী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে প্রতিষ্ঠানের নীতি ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নিকট তুলে ধরা হয়। এতে উর্ধ্বতন ও অধস্তনের মধ্যে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং এর ফলে উত্তম শ্রম ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক তৈরি হয়।
১০. দক্ষতা বৃদ্ধি
এরূপ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবস্থাপনার দক্ষতার উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কেননা এরূপ বাজেট প্রণয়নের সময় ব্যবস্থাপকদেরকে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করতে হয় যা তাদের মধ্যে আত্ম-সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করে এবং ব্যবস্থাপকদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটায়।
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণের অসুবিধা
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সংখ্যাত্মক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া। অর্জিত ফলাফলকে বাজেটের সাথে তুলনা করে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাজেটারী নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত কার্যকর। তারপরেও এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। নিচে অসুবিধাগুলো বর্ণনা করা হলো-
১. পূর্বানুমানের সমস্যা
কতগুলো পূর্বানুমানের উপর ভিত্তি করে বাজেট প্রণয়ন করা হয়। অনেক সময় এই আনুষ্ঠানিক হিসাব বাস্তবভিত্তিক নাও হতে পারে। এতে বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থ হয়।
২. নমনীয়তার অভাব
পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারলে সেই বাজেট পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নিশ্চিত করতে পারে না। তাই এ পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বাজেটে পরিবর্তন আনয়ন করা অত্যন্ত জটিল ও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
৩. ব্যয়বহুল
বাজেট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এই ব্যয় বহন করা অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই সম্ভব হয় না।
৪. সময় সাপেক্ষ
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় নানাবিধ তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করার প্রয়োজন হয়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য প্রচুর সময় লেগে যায়। সুতরাং বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সময়সাপেক্ষও বটে।
৫. অধিক নির্ভরতা
বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণে নির্বাহীগণ বাজেটের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর এই অতি নির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠানের জন্য কখনও কখনও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৬. ব্যাপক অংশগ্রহণের অভাব
বাজেটের সফলতার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যবস্থাপকগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করেন না। এতে বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়।
৭. সমন্বয়ের অভাব
বাজেট প্রণয়নের সময় সামগ্রিক কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে বিভাগীয় প্রধানগণ নিজ নিজ বিভাগের ব্যয় বরাদ্দ নিয়েই অধিক আগ্রহী থাকেন। ফলে সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাবে কর্মক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
৮. সময় নির্ধারণের সমস্যা
বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এর সময়কাল নির্ধারণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সময় বিভিন্ন বিভাগের প্রয়োজনে বিভিন্ন মেয়াদের বাজেট তৈরি করতে হয়। যথাযথভাবে বাজেটকাল বা সময় নির্ধারণ করতে না পরলে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
উল্লেখিত অসুবিধাগুলো অনেক সময়ই বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তোলে। তবে নির্বাহীগণের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই বাজেটকে কার্যকর, গতিশীল ও বাস্তবমুখী করে তুলতে পারে।