পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন। জলবায়ুর ভিন্নতাহেতু মানুষের জীবন জীবিকাও ভিন্নতর হয়।
নিরক্ষীয় জলবায়ু
যে জলবায়ু নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহে পরিলক্ষিত হয় সে জলবায়ুকে নিরক্ষীয় জলবায়ু বলে। অর্থাৎ নিরক্ষরেখার ৫° উত্তর ও ৫° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে যে জলবায়ু বিরাজ করে তাকে নিরক্ষীয় জলবায়ু বলে। নিরক্ষারেখার ৫°-১০° উত্তর ও দক্ষিণ। অক্ষাংশের মধ্যবর্তী স্থানে পৃথিবীর মধ্যভাগে প্রায় ৯৭০ কিলোমিটারব্যাপী নিরক্ষীয় জলবায়ু বিস্তৃত।
আমাজান নদী অববাহিকার বিস্তীর্ন অঞ্চলে এ জলবায়ুর তীব্রতা বেশি অনুভূত হয় বলে একে আমাজানীয় জলবায়ু নামেও অভিহিত করা হয়।
জলবায়ুর নিয়ামক গুলো কি কি? |
নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য
নিম্নে নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. অবস্থান
নিরক্ষরেখার ৫°-১০° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল অবস্থিত। নিরক্ষরেখার উভয় পার্শ্বে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার জুড়ে এ অঞ্চল বিস্তৃত।
২. জলবায়ু
নিরক্ষীয় অঞ্চলের জলবায়ু প্রধানত নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারা বছর সূর্যরশ্মি অধিক লম্বভাবে পড়ে, তাপ ও বৃষ্টিপাত অধিক এবং দিনরাত্রির দৈর্ঘ্য প্রায় সমান। নিম্নে এ অঞ্চলের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো-
ক. তাপমাত্রা: নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারা বছর তাপমাত্রা সমানভাবে বিরাজ করে। এ অঞ্চলে সূর্যকিরণ লম্বভাবে পড়ে বলে উষ্ণতা বেশি। বাৎসরিক গড় উত্তাপ ২২° সে. হতে ৩৪° সে।
খ. বায়ুর চাপ ও বায়ুপ্রবাহ: এ অঞ্চলে সারা বছর দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য প্রায় সমান থাকে এবং সূর্যকিরণ লম্বভাবে পতিত হওয়ার বায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং স্ফিত ও হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। ফলে এ অঞ্চলে সারা বছর বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ এ জলবায়ুর অপর একটি বৈশিষ্ট্য।
গ. বৃষ্টিপাত: এ অম্মলে জলভাগ বেশি এবং প্রচন্ড উত্তাপ থাকায় নিম্ন বলয়ের সৃষ্টি হয়। ফলে একদিকে আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয় এবং উত্তপ্ত হয়ে উপরে উঠে অন্যদিকে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠে এবং উর্ধ্বে প্রসারিত ও শীতল হয়ে প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টিপাত ঘটায়।
ঘ. ঋতু পরিবর্তন: নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারা বছর একই রকম জলবায়ু বিরাজ করে। এ অঞ্চলে সারা বছর সূর্য খাড়াভাবে কিরণ দেয় বলে এখানে জলবায়ুর ঋতুগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না।
৩. ভূ-প্রকৃতি
নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতিতে বৈচিত্র্যতা পরিলক্ষিত হয়। এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি উচুনিচু সমতল ভূমি দ্বারা গঠিত।
৪. উদ্ভিজ্জ ও বনাঞ্চল
উচ্চ তাপমাত্রা ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য নিরক্ষীয় অঞ্চলে পত্রযুক্ত চিরহরিৎ বৃক্ষের গভীর অরণ্য দেখা যায়। সূর্যালোক পাওয়ায় এ অঞ্চলের বৃক্ষগুলো খুব উঁচু হয় এবং কোনো কোনো বৃক্ষের উচ্চতা ৫০ মিটারেরও অধিক হয়ে থাকে।
৫. মৃত্তিকা
নিরক্ষীয় অঞ্চলের মৃত্তিকা খুব উর্বর নয়। অধিক উত্তাপ ও বৃষ্টিপাতের জন্য মৃত্তিকা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
৬. কৃষিকার্য
বর্তমানে নিরক্ষীয় অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে কৃষিকার্য বেশ উন্নতি লাভ করেছে। কৃষিকার্যের মাধ্যমে ধান, গম, ইক্ষু, রবার, সাগু, কোকো প্রভৃতি পণ্য উৎপন্ন হয়।
৭. জীবজন্তু ও প্রাণিজ সম্পদ
নিরক্ষীয় অঞ্চলে তৃণভোজী জন্ত খুব কম দেখা গেলেও বৃক্ষচারী জীবজন্তুর সংখ্যাই বেশি। বৃক্ষচারী জীবজন্তু, যেমন- বানর, গেরিলা, শিম্পাঞ্জি, গেছো ব্যাঙ, গিরগিটি ও বিভিন্ন ধরনের পাখি এ অঞ্চলের প্রধান জীবজন্তু।
৮. খনিজ সম্পদ
এ অঞ্চলে অধিকাংশ খনিজ সম্পদগুলো অনাবিষ্কৃত রয়েছে। তবে এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদগুলো হলো- টিন, খনিজ তেল, গ্রাফাইট, হীরক, তাম্র, বক্সাইট, ম্যাঙ্গানিজ, কয়লা প্রভৃতি।
আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যে পার্থক্য এবং জলবায়ুর উপাদান গুলো কি কি? |
৯. পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে রাস্তা ও রেলপথ নির্মাণ করা খুব কষ্টকর ও ব্যয়সাপেক্ষ। তাই পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম হলো নদীপথ।
১০. শিল্প ও বাণিজ্য
মূলধনের অভাব, বিরল জনবসতি, অনুন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা প্রভৃতি কারণে এ অঞ্চল শিল্প ও বাণিজ্যে অনুন্নত।
১১. উপজীবিকা
ফলমূল এ অঞ্চলের অধিবাসীদের পশু শিকার ও অন্যান্য বনজ সম্পদ আহরণ ও প্রধান উপজীবিকা। তবে বর্তমানে অনেকে কৃষিকাজ, খনিজ সম্পদ আহরণ এবং শিল্প বাণিজ্যের মাধ্যমেও জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
১২. অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ
নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলো কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নত না হলেও এদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। এ অঞ্চলে কৃষিকার্যের উন্নতির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের খনিজ সম্পদগুলোর বেশির ভাগ অনাবিষ্কৃত রয়েছে।
উপসংহার
নিরক্ষীয় অঞ্চলের জলবায়ু এ অঞ্চলগুলোর কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক জীবনযাত্রা প্রণালিকে প্রভাবিত করে থাকে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল এবং সম্ভাবনাময়।